বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
অর্থ- আল্লাহর নাম নিয়ে পড়া শুরু করছি, যিনি সীমাহীন দয়ালু এবং সীমাহীন করুণাময়।
নাযিল : মাদীনাহ, আয়াত : 24 টি।
মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুই আল্লাহ পবিত্রতা বর্ণনা করে।
59:1 নং আয়াহ : যা কিছু রয়েছে মহাবিশ্বে ও যা কিছু রয়েছে পৃথিবীতে, সমস্ত কিছুই তার পবিত্রতা [17:44] বর্ণনা করে [59:24]। আর তিনি মহা শক্তিশালী ও মহা বিজ্ঞানী।
বানু নাদ্বীর গোত্র ‛মাদীনাহ সনদ’ অস্বীকার করেছিল।
59:2 নং আয়াহ : তিনিই (আল্লাহ), যিনি আহলে কিতাব (ইয়াহুদী) দের মধ্যে যারা (মাদীনাহ সনদ) অস্বীকার করেছিল, তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি গুলো হতে বহিষ্কার করেছেন প্রথম চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য। তোমরা ভাব নি যে, তারা বের হবে। আর তারা ভেবে ছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর থেকে বাঁচিয়ে নেবে। কিন্তু আল্লাহ তাদের কাছে এমন দিক হতে আসলেন (১), যা তারা কল্পনাও [16:26] করে নি। এবং তাদের মস্তিষ্কে ভয়ের সঞ্চার করলেন। তারা তাদের নিজেদের হাত গুলো দ্বারা তাদের ঘরবাড়ি গুলো ধ্বংস করল (২) এবং মূমীনদের হাত গুলোও। সুতরাং জ্ঞান অর্জন চালিয়ে যাও ‛হে অধিক দৃষ্টি সম্পন্নরা’ (৩)।
১ এটা আরবি বাক রীতি, প্রচলিত কথা। এখানে আল্লাহ আসলেন বলতে, আল্লাহর শাস্তি আসল।
২ নাবী (সা) মাদীনাহতে আসেন। তখন মাদীনাহতে 70-72 টা মতো ইয়াহুদী গোত্র ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি গোত্র আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন- বানু কাইনুকা, বানু নাদ্বীর ও বানু কুরাইজ্বা। এই আয়াহতে বানু নাদ্বীরের কথা বলা হয়েছে।
বিষয়টি ছিল এই রকম- ইহুদী গোত্র গুলোর সঙ্গে চুক্তি করে মাদীনাহ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। যা ‛মাদীনাহ সনদ’ নামে পরিচিত, যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ও প্রাথমিক লিখিত সংবিধান। সনদে প্রায় 47 (মতভেদে 53) টি ধারা ছিল। যার মধ্যে আন্যতম ধারা ছিল- মাদীনাহর ইহুদী নাগরিকরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বহিশত্রুকে সাহায্য করবে না এবং মুসলিমরাও ইহুদীদের বহিশত্রুকে সাহায্য করবে না (16 নং ধারা)। এছাড়াও ছিল- মাদীনাহ বহিশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে দেশের সমস্ত নাগরিকরা তাতে অংশ নেবে ও দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসবে। এছাড়াও মাদীনাহর শত্রুদেরকে কেউ সাহায্য করবে না (48 নং ধারা)।
ছিল আরও অন্যান্য ধারা, যা এখানে উল্লেখযোগ্য মনে করছি না। বদর যুদ্ধ হয় মাক্কাহর অমুসলিম ও মাদীনাহর মুসলিমদের মধ্যে। তাতে ইহুদী গোত্র গুলো মুসলিমদের শত্রুকে সাহায্য করে নি। যদিও তারা মুসলিমদের পক্ষ নেয় নি। কিন্তু সনদ অনুযায়ি পক্ষ নেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তবুও নাবী (সা) এটাকে ‛অপরাধ ও চুক্তি ভঙ্গ’ বলে গণ্য করেন নি। এটা নাবী (সা) এর উদারতা ও মহানতা।
যাইহোক, মুসলিমরা বদর যুদ্ধে মারাত্মক ভাবে বিজয়ী হয়। আরব বিশ্ব মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধতা, ক্ষমতা ও ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে। ইহুদীরাও নড়েচড়ে বসে। তারা ভাবতে থাকে- “মুসলিমরা এভাবে শক্তিশালী হলে তারা কোনঠাসা হয়ে পড়বে”। তাই তারা ভিতরে ভিতরে মুসলিমদেরকে দুর্বল করার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র শুরু করে। এমনটাই চাইছিল বদর যুদ্ধে পরাজিত হওয়া মাক্কাহর অমুসলিমরা।
মাক্কাহর অমুসলিম ও মাদীনাহর ইহুদীদের মধ্যে গোপনে চিঠি আদান প্রদানও চলতে থাকে। এরই মধ্যে মাদীনাহর ‛বানু কাইনুকা গোত্র’ মাক্কাহর মাদীনাহ সনদ অস্বীকার করে। শাস্তি স্বরূপ মাদীনাহ থেকে বিতাড়িত হয়ে সিরিয়ায় দেশান্তর হয়।। তাই মাদীনাহর অন্যান্য ইহুদী গোত্র গুলো ভীত সন্ত্রস্ত ও মুসলিমদের প্রতি তীব্র ঘৃণা বহন করতে থাকে।
বদর যুদ্ধের পর মাক্কাহর কুরাইশ গোত্রের অমুসলিমরা মাদীনাহর ইহুদীদের প্রতি চিঠি লিখেছিলেন, যাতে ছিল- “তোমরা অস্ত্রে সসজ্জিত ও দুর্গের অধিকারী। তোমরা আমাদের সাথী (মুহাম্মদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, নয়ত আমরা এই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করব। তখন আমাদের ও তোমাদের নারীদের দাসী বানানোর মাঝে কোনও প্রতিবন্ধকতা থাকবে না” (আবুদাউদ, হাদীশ 3004)। এতে বানু নাদ্বীর গোত্র নাবী (সা) কে হত্য এবং মাদীনাহ থেকে মুসলিমদের বহিষ্কার করার পরিকল্পনা করে।
তাদের পরিকল্পনা/ চক্রান্ত ছিল- “নাবী (সা) কে সহ 30 জন সাহাবা (রা) কে ধর্মীয় বিতর্ক করার আহ্বান করবে। নাবী (সা) সেখানে গেলে বিতর্ক চলাকালীন তাকে ও সাহাবা (রা) দের হত্যা করবে”। তাদের চিঠি পাওয়া সহ তাদের পরিকল্পনা ও চক্রান্ত/ ষড়যন্ত্রের খবর নাবী (সা) এর কাছে আসে।
ইতিমধ্যে ধনী মুসলিমরা মাদীনাহ রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দিতেন। ট্যাক্স বলতে শুধু ইনকাম ট্যাক্স নয়, পশু এবং ফসলের ট্যাক্সও দিতেন। যা যাকাত নামে পরিচিত। কিন্তু ইহুদী গোত্র গুলো কোনও ধরণের ট্যাক্স দিতেন না। যাইহোক, শর্ত ছিল- “মুসলিমদের শত্রুদেরকে সাহায্য করবে না এবং মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে”।
কিন্তু তারা চুক্তি ভঙ্গ করে এবং মাদীনাহ রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে। এটা ছিল সুস্পষ্ট দেশদ্রোহীতা। এখন যেহেতু রাষ্ট্রকে রক্ষার দায়িত্ব শুধু মুসলিমদের, তাই ইহুদীদের থেকে ট্যাক্স/ জিজিয়া দাবী করা হয়। বলা হয়- “এখন ইহুদীরা জিজিয়া দেওয়ার বদলে রাষ্ট্রের সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত”। তারমানে, জিজিয়া মূলত সামরিক ট্যাক্স।
(অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকরা জিজিয়া দেওয়ার বদলে রাষ্ট্রের পক্ষে সামরিক পরিষেবা দেওয়া হতে মুক্তি পেত। অন্য দিকে রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকরা যাকাতও দিতেন, আবার সামরিক পরিষেবা দিতেও বাধ্য থাকতেন। বলে রাখা উচিৎ যে, জিজিয়া থেকে মুক্ত ছিলেন- ধর্মগুরুরা, বৃদ্ধ পুরুষ (ধনী হলেও), নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীরা। আর তারাও মুক্ত ছিলেন, যারা রাষ্ট্রের পক্ষে সামরিক পরিষেবা দিতেন। অন্যদিকে মুসলিমরা পুরুষ বৃদ্ধ হলেও ধনী হলেই যাকাত দিতে বাধ্য। নারীও ধনী হলে যাকাত দিতে বাধ্য থাকতেন, এমনকি বৃদ্ধা হলেও)।
কিন্তু বানু নাদ্বীর গোত্র জিজিয়া দিতেও অস্বীকার করে। অন্যদিকে আল্লাহ মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেন- “ইয়াহুদীদের কাছে দুটি পন্থা রয়েছে। ইসলাম গ্ৰহণ করুক, নয়ত জিজিয়া দিক। নয়ত তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর”(9:29)। তাই নাবী (সা) সাহাবা (রা) দের একটা দলকে নিয়ে বানু নাদ্বীর গোত্রকে অবরোধ করেন। তাতেও তারা সম্মত হয় নি। “পরিশেষে বানু নাদ্বীর গোত্র মাদীনাহ থেকে বহিষ্কৃত হতে সম্মত হয়। যদিও অন্যান্য ইহুদী গোত্র গুলি জিজিয়া দিতে (যেমন, বানু কুরাইজ্বা) সম্মত হন” (আবুদাউদ, হাদীশ 3004)।
নাবী (সা) উদারতা দেখিয়ে বলেন- “তোমাদের যত কিছু রয়েছে, তার মধ্যে যা যা উটের পিঠে বহন করে নিয়ে যেত পার, নিয়ে যাও” (আবুদাউদ, হাদীশ 3004)। তারা এত পরিমাণ মুসলিম বিদ্বেষ রাখতেন যে, তারা তাদের ঘরবাড়ি গুলো নিজেরা ধ্বংস করে দেন। যাতে মুসলিমরা সেগুলো ব্যবহার করতে না পারে। সেই পেক্ষিতেই বলা হল- “তারা তাদের নিজেদের হাত গুলো দ্বারা তাদের ঘরবাড়ি গুলো ধ্বংস করল”(59:2)।
৩ ‛হে অধিক দৃষ্টি সম্পন্নরা’- এর অর্থ কি?? এর অর্থ খুব সুন্দর। আমরা জানি- জ্ঞানের সবচেয়ে বড় শাখা হল ‛মহাকাশ বিদ্যা’। আধুনিক মহাকাশ বিদ্যার সূচনা হয়েছিল বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের হাত ধরে। যখন তিনি অধিক দৃষ্টির ব্যবহার করে দেখলেন যে, “গ্যালাক্সি গুলো একটা অন্যটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে”। এভাবেই সূচনা হয়েছিল আধুনিক মহাকাশ বিদ্যার যাত্রা/ অগ্ৰগতি। আল্লাহ এখানে সেটাই তুলে ধরেছেন।
বানু নাদ্বীর গোত্রকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।
59:3 নং আয়াহ : যদি আল্লাহ তাদের জন্য নির্বাসন লিখে না রাখতেন [5:33], তাহলে অবশ্যই তাদেরকে ইহজীবনেই শাস্তি দিতেন। তবে, তাদের জন্য পরবর্তী জীবনে থাকবে আগুনের শাস্তি [68:33]।
# বানু নাদ্বীর গোত্র বহিষ্কৃত হয়ে খায়বার ও অন্যান্য স্থানে চলে যান।
বানু নাদ্বীর গোত্র নিজেদের কৃত চুক্তির বিরুদ্ধে গিয়েছিল।
59:4 নং আয়াহ : ওটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের (সঙ্গে কৃত চুক্তির) বিরুদ্ধে গিয়েছিল। আর যে আল্লাহর বিরুদ্ধে যাবে, (সে জেনে রাখুক) আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।
বানু নাদ্বীরের খেঁজুর বাগান নাবী (সা) এর দখলে আসে।
59:5 নং আয়াহ : তোমরা খেঁজুর গাছের মধ্যে যা কেটেছ ও নষ্ট করেছ অথবা যা তাদের কান্ডের উপর ছেড়ে দিয়েছ। তা তো আল্লাহর অনুমতিতেই। যাতে তিনি ফাসিক (চুক্তি ভঙ্গকারী) দের লাঞ্ছিত করতে পারেন।
# বানু নাদ্বীর গোত্রের ইহুদীরা তাদের ধনসম্পদ যতটা পেরেছিল, বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। ঘরবাড়ি নিজেরাই ধ্বংস করেছিল, মুসলিমরাও। তাদের বাগানের কিছু অংশ মুসলিম ধ্বংস করেছিলেন” (বুখারী, হাদীশ 4031)। বাদবাকি বাগান নাবী (সা) এর দখলে আসে। তবে “এ সম্পদ বিনা যুদ্ধে অর্জিত হয়। নাবী (সা) এ সম্পদের বেশিরভাগই মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। 2 জন অভাবী আনসারকেও তিনি এর অংশ দিলেন” (আবুদাউদ, হাদীশ 3004)।
# হাদীশ অস্বীকারকারীরা বলেন- “পবিত্র কুরআন একমাত্র ওহী”। কিন্তু এই আয়াহ বলছে- “খেঁজুর গাছের মধ্যে যা কেটেছ ও নষ্ট করেছ অথবা যা তাদের কান্ডের উপর ছেড়ে দিয়েছ। তা তো আল্লাহর অনুমতিতেই”। কিন্তু পবিত্র কুরআনে এর কোনও অনুমোদন নেই। মানে, এই অনুমোদন ছিল পবিত্র কুরআনের বাইরে”। মানে, পবিত্র কুরআনের বাইরে ওহী হোত।
ফায় কি??
59:6 নং আয়াহ : আর আল্লাহ তাদের (ইয়াহুদীদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি) থেকে রাসূলকে ‛ফায়’ হিসাবে যা দিলেন, তার জন্য তোমাদেরকে না ঘোড়া দৌড়াতে হয়েছে, আর না উট। আল্লাহ তার রাসূলদেরকে যার উপর চান, প্রাধান্য দিয়ে থাকেন (১)। কেননা, আল্লাহ সমস্ত কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
# এমন সম্পদ সম্পত্তিকে ‛ফায়’ বলা হয়, যা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা জন্য যুদ্ধ ছাড়াই পাওয়া যায় এবং মুসলীম বাহিনীর কোনও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই যা অর্জন হয়। গনিমত থেকে ফায় ভিন্ন। যুদ্ধ ছাড়া গনিমত লাভ করা যায় না।
১ ফায় সম্পর্কে হাদীশ- “রাসূল (সা) এ সম্পদ থেকে তার পরিবারের এক বছরের ভরণ পোষণের পরিমাণ নিতেন এবং অবশিষ্ট সম্পদ মুসলিমদের কল্যাণে ব্যায় করতেন” (আবুদাউদ, হাদীশ 2963)। এছাড়াও ঐ সম্পদ দিয়ে নাবী (সা) “ঘোড়া ও আল্লাহর পথে যুদ্ধের সরঞ্জাম সংগ্রহ করতেন”(আবুদাউদ, হাদীশ 2965)।
এখানে প্রশ্ন হবে- নাবী (সা) এর মৃত্যুর পর ঐ সম্পদের কি হয়েছিল?? কি হবে, তা নাবী বলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- “ আমার ওয়ারিসগণকে আমার পরিত্যক্ত একটি দীনারও বণ্টন করবে না। আমার স্ত্রীদের ভারণপোষণ এবং কৃষি শ্রমিকদের বেতন দেয়ার পর যা থাকবে, তা সাদাকাহ/ দান গণ্য হবে” (আবুদাউদ, হাদীশ 2974)।
তারপর কি হয়েছিল?? দেখুন- “রাসূল (সা) তার সম্পদ থেকে নিজ পরিবারের জন্য খরচ করতেন এবং বাদবাকী অংশ দান করতেন। অতঃপর রাসূল (সা) ইন্তেকাল করলেন। আবূ বকর (রা) 2 বছর তার ঐ সম্পত্তির মোতাওয়াল্লী থাকলেন। রাসূল (সা) ঐ সম্পত্তির আয় যেসব খাতে ব্যয় করতেন, পরবর্তীতে আবূ বকরও তাই করলেন”(আবুদাউদ, হাদীশ 2975)।
কোন কোন খাতে ‛ফায়’ খরচ করা হবে??
59:7 নং আয়াহ : আর আল্লাহ জনপদবাসীদের (ইয়াহূদী দের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি) থেকে ফায় হিসাবে তার রাসূলকে যা দিলেন, তা আল্লাহ ও তার রাসূলের। নিকটস্থ সঙ্গী সাথীদের (মুসলীম বাহিনীর), অনাথদের, নিরুপায় গরীবদের এবং রাস্তার পুত্রদের। যাতে সম্পদে সম্পত্তি তোমাদের মধ্যে যারা ধনী, তাদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়। আর রাসূল তোমাদেরকে (তা হতে) যা দেন, তা গ্ৰহণ কর। আর যা নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। সুতরাং আল্লাহর জন্য তাকওয়া (অপকর্ম থেকে দূরত্ব) অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
# ‛রাস্তার পুত্র’ বলতে! এটা আরবি বাক রীতি। যার অর্থ- রাস্তাই যাদের ঠিকানা বা বসবাসের জায়গা। যাদের সম্পদ সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই।
ফায় মুহাজীর (মাক্কাহ থেকে আগত মুসলিম) দের জন্যেও।
59:8 নং আয়াহ : নিঃস্ব মুহাজীরদের জন্য, যারা তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে ও তাদের ধনসম্পদ সমূহ থেকে। তারা পেতে চায় আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি। তারা সাহায্য করে আল্লাহ ও তার রাসূলকে [47:7]। তারা সত্যবাদী [9:119]।
ফায় আনসার (মাদীনাহর মুসলিম) দের জন্যেও।
59:9 নং আয়াহ : আর (তাদের জন্যও) যারা নগরীর (মদীনার) বাসিন্দা। যারা তাদের (মুহাজীরদের) আগমনের পূর্বে ইমান এনেছিল। আর যারা তাদের (মুহাজীরদের) কে ভালোবাসে, যারা তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে। তা (ফায়) থেকে তাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে, তাতে তারা কোনও ইর্ষা করে না, তারা তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও নিজেরা থাকে অভাব অনটনে। আর যে কৃপণতা [3:180] থেকে নিজেকে রক্ষা করবে, তারাই সফলতা পাবে।
সমস্ত মূমীনদের জন্য, যারা সাহাবা (রা) দের প্রতি ঘৃণা রাখে না।
59:10 নং আয়াহ : আর (তাদের জন্যও), যারা এসেছে তাদের পরে, তারা বলে- “হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরও। যারা আমাদের অগ্ৰগামী হয়েছে ইমান আনার ক্ষেত্রে। তাদের প্রতি আমাদের মস্তিষ্কে কোনও হিংসা বিদ্বেষ রাখবেন না, যারা ইমান আনে। হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয়ই আপনি স্নেহশীল ও করুণাময়”।
# এই আয়াহতে মুহাজীর ও আনসারদের পরে ইমান আনা সমস্ত মূমীনদের কথা বলা হয়েছে। তবে শর্ত হল- তারা যেন মুহাজীর ও আনসার তথা সাহাবা (রা) দের জন্য দুয়া করে, সাহাবা (রা) দের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ তথা ঘৃণা পোষণ করে না। অন্য ভাবে বললে হবে- যারা সাহাবাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তারা ফায় পাওয়ার যোগ্য নয়।
বানু নাদ্বীর ও মুনাফিকদের গোপন আঁতাত ছিল।
59:11 নং আয়াহ : আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা মুনাফিক! তারা তাদের (মাদীনাহ সনদ) অস্বীকারকারী আহলে কিতাব (ইয়াহুদী) ভাইদেরকে বলে- “যদি তোমদেরকে বহিষ্কৃত করা হয়, তবে আমরাও তোমাদের সঙ্গে বের হয়ে যাব। আমরা তোমাদের ব্যাপারে কারোর (মুহাম্মাদের) হুকুম মানব না। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব”। তবে আল্লাহ সাক্ষ্য [58:6] দিচ্ছেন- “নিশ্চয়ই তারা মহা মিথ্যাবাদী” [63:1]।
# মাদীনাহর মুনাফিকরা ইসলামকে সত্য জেনে ইসলামের অন্যান্য বিধান মেনে চলত। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়ার পর থেকে তারা বেঁকে বসেন। তারা যাকাত প্রদান করতে চাইতেন না। অন্য দিকে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য ট্যাক্স প্রয়োজন, দ্বিতীয় উপায় নেই। একারণে তারা যাকাত দিতে সম্মত হলেও, মন থেকে মেনে নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যাকাত দিতেন না।
মাদীনাহর মুসলিমদের মধ্যে 2-1 হাজার মুসলিম এই মুনাফিকীতে লিপ্ত ছিল। তাদের নেতা ছিল- আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই। মাক্কাহর কুরাইশ অমুসলিমরা মাদীনাহর আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার মুশরিক/ মূর্তিপূজক সহযোগী আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে গোপনে চিঠি আদান প্রদান চলত। এছাড়াও কুরাইশ অমুসলিমদের সঙ্গে মাদীনাহর ইহুদী গোত্র গুলোর সঙ্গেও চিঠি আদান প্রদান চলত। একারণে মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের সঙ্গে বানু নাদ্বীর ও অন্যান্য ইহুদী গোত্র গুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল।
কেননা, মুনাফিকরা ও ইহুদী গোত্র গুলো উভয়েই ট্যাক্স দিতে চাইতেন না। তাই উভয়ের সাধারণ শত্রু ছিলেন নাবী (সা) ও মুসলিমরা। এছাড়াও আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইহুদী গোত্র গুলোর নেতৃত্ব করতে চাইতেন এবং নাবী (সা) ও মুসলিমদের শেষ করে দিয়ে মাদীনাহর নেতা হতে চাইতেন।
একারণে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই বানু নাদ্বীর গোত্রকে গোপনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- “যদি তোমদেরকে বহিষ্কৃত করা হয়, তবে আমরাও তোমাদের সঙ্গে বের হয়ে যাব। আমরা তোমাদের ব্যাপারে কারোর (মুহাম্মাদের) হুকুম মানব না। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব”।
ইহুদীদের সঙ্গেও মুনাফিকরা ধোকাবাজি করেছিল।
59:12 নং আয়াহ : কেননা, যদি তারা (ইয়াহুদীরা) বহিষ্কৃত হয়, তবে তারা (মুনাফিকরা) তাদের সঙ্গে বের হবে না। যদি তাদের (ইয়াহুদীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে তাদেরকে সাহায্যও করবে না। আর করলেও পিট দেখিয়ে পালাবে, তারপর তাদেরকে আর সাহায্য করা হবে না।
# আসলে মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের কাছে মাক্কাহর কুরাইশ অমুসলিমদের পক্ষ থেকে চিঠি আসে। যাতে ছিল- “আমাদের এক ব্যক্তিকে (মুহাম্মাদকে) তোমরা আশ্রয় দিয়েছো। আমরা আল্লাহর শপথ করে বলছি- তোমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধর বা বহিস্কার কর। অন্যথায় আমরা সম্মিলিতভাবে তোমাদেরকে আক্রমণ করব, তোমাদের যুদ্ধবাজ লোকদের হত্যা করব এবং তোমাদের নারীদেরকে বন্দী করবো। … চিঠিটি আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার মূর্তিপূজক সঙ্গীদের নিকট পৌঁছলো তারা রাসূল (সা) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হল” (আবুদাউদ, হাদীশ 3004)।
ট্যাক্স ছাড়া রাষ্ট্র অচল, এটা মুনাফিকরা বুঝত না।
59:13 নং আয়াহ : অবশ্যই তাদের মস্তিষ্ক সমূহে আল্লাহর চেয়ে তোমাদের প্রতি ভয় বেশি। ওটা এজন্য যে, তারা (মুনাফিকরা) এমন এক সম্প্রদায়, যারা সত্য বোঝে না।
# ‛সত্য বোঝে না’ বলতে! কোন সত্য?? এটাই যে, ট্যাক্স রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা ও জন কল্যাণ করা সম্ভব নয়। মুনাফিকরা নিজেরা ট্যাক্স দিতে চাইত না, অন্যকে ট্যাক্স দিতে বাধা দিত এই সম্পর্কে আরও জানতে দেখুন 63:7-8 আয়াত।
মুনাফিক ও ইয়াহুদীদের আঁতাত সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী।
59:14 নং আয়াহ : তারা (ইয়াহুদী ও মুনাফিকরা) একত্রিত হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। তবে যুদ্ধ করতে পারে সুরক্ষিত এলাকা বা দুর্গের প্রাচীরের আড়াল থেকে। (তারা যুদ্ধ করতে না পারলেও তোমাদের প্রতি) তাদের মধ্যে রয়েছে বিরুদ্ধতা। আপনি ভাবেন- “তারা ঐক্যবদ্ধ”। কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক সমূহ দ্বিধাবিভক্ত। ওটা একারণে যে, তারা এমন সম্প্রদায়, যাদের জ্ঞান নেই।
# মূলত একটি সাধারণ বিষয় নিয়ে এত ঝামেলা। আর সেটা হল ট্যাক্স। ইহুদী গোত্র গুলো ও মুনাফিকরা ট্যাক্স দিতে চাইতেন না (63:7-8)। অথচ ট্যাক্স ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা ও জন কল্যাণ করা অসম্ভব। এজন্য এখানে তাদের সম্পর্কে এখানে বলা হচ্ছে যে, “তারা এমন সম্প্রদায়, যাদের জ্ঞান নেই”।
বানু নাদ্বীরের পরিণতি হয়েছিল বানু কাইনুকা গোত্রের মতো।
59:15 নং আয়াহ : তাদের (বানু নাদ্বীরের) উদাহরণ হল- তাদের পূর্ববর্তী (বানু কাইনুকা) দের মতো। যারা কিছুদিন/ কিছুকাল আগেই তাদের কুকর্মের স্বাদ পেয়েছে। তাদের জন্য থাকবে কষ্টদায়ক শাস্তি।
# আসলে বানু নাদ্বীর গোত্রের সঙ্গে যা ঘটেছিল, ইতিপূর্বে বানু কাইনুকা গোত্রের সঙ্গেও তাই ঘটেছিল। ইতিহাসটা বলব, শুনুন- মাদীনাহর একজন মুসলিম নারী কিছু পণ্যদ্রব্য নিয়ে বানু কাইনুকা গোত্রের বাজারে বিক্রি করতে যান। সেখানে ঐ মুসলিম নারী এক স্বর্ণকারের দোকানের কাছে বসেন (বানু কাইনুকা গোত্র বণিক ও স্বর্ণের ব্যাবসার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল)। দোকানের লোকেরা ঐ মুসলিম নারীকে মুখ খুলতে বলেন। কিন্তু ঐ নারী তা করতে অস্বীকার করেন। অতঃপর স্বর্ণকার ঐ নারীর পরিধানের কাপড়ের একটা কোণা ধরে তার পিঠের সাথে বেঁধে দেয়। ঐ নারী এটা বুঝতে পারে নি। ফলে ঐ নারী উঠে দাঁড়ালে তার কাপড়ে টান লেগে কাপড় খুলে যায়, তিনি উলঙ্গ হয়ে যান। বাজারের লোকেরা তা দেখে হো হো করে হেসে ওঠেন। ঐ নারী সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠেন। তখন একজন মুসলিম পুরুষ স্বর্ণকারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলেন। স্বর্ণকার ছিলেন- ইহুদী। তাই ইহুদীরাও সংঘবদ্ধ হযে ঐ মুসলিমকে হত্যা করে ফেলেন। তখন ঐ নিহত মুসলিম পরিবার পরিজন মুসলিমদের কাছে বদলার আবেদন জানায়। মুসলিমরা একত্রিত এবং উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বনু কাইনুকার সাথে মুসলিমদের দাঙ্গা বেঁধে যায় বা দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়। তারপর বানু কাইনুকা মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু নাবী (সা) সাহাবা (রা) দের একটা দল নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন, এগিয়ে যান। বানু কাইনুকা ভয় পেয়ে যায় এবং দূর্গে আশ্রয় নেয়। তারপর নাবী (সা) তাদেরকে 15 দিন অবরোধ করেন। তখন তারা আত্মসমর্পণ করে।
এখানে প্রথম দোষ ছিল ঐ ইহুদী স্বর্ণকারের। দ্বিতীয় দোষটা করেন ঐ মুসলিম, যিনি ঐ ইহুদী স্বর্ণকারকে হত্যা করে ফেলেন। যদি ঘটনাটা ঘটে যায় উত্তেজনায়। এখানে ইহুদীদের উচিৎ ছিল- “বিচারকের কাছে ন্যায় বিচারের আবেদন জানান” (মাদীনাহ সনদের 46 নং ধারা)। কেননা, মাদীনাহ সনদ অনুযায়ি- হত্যার বিচার হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ইহুদীরা তা না করে ঐ মুসলিমকে একত্রিত হয়ে দলবদ্ধ ভাবে হত্যা করেন। এর উত্তরে ইহুদী ও মুসলিমদের দাঙ্গা লেগে যায়। এখানে সুস্পষ্ট যে, ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। এছাড়াও মাদীনাহ সনদের 40 নং ধারায় বলা ছিল- “ইহুদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে, মুসলিমরা ইহুদীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে না/ যুদ্ধ করবে না। কিন্তু ইহুদীরা সংবিধান লঙ্ঘন করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্ৰহণ করেন।
যেহেতু এখানে সামগ্রিক ভাবে গোত্র দায়ি, তাই রাসূল (সা) তাদেরকে অবরোধ করে অনুকূল শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। যদিও তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা মতো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। তাই রাসূল (সা) তাদেরকে অবরোধ করতে বাধ্য হন। এভাবে আল্লাহর সাহায্যে রাসূল (সা) তাদেরকে নতজানু করলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার কাছে এসে বললেন- “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের প্রতি সদয় আচরণ করুন”।
রাসূল (সা) তার এ কথায় কোন উত্তর দিলেন না। তিনি আবার বললেন- “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করুন”। রাসূল (সা) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার তিনি রাসূল (সা) এর বর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন তিনি (মুহাম্মাদ) বললেন- “আমাকে ছাড়”। এই সময় রাসূল (সা) এত ক্রুদ্ধ হন যে, তার মুখমণ্ডল রক্তের মতো লাল হয়ে যায়। তারপর তিনি তাকে বললেন- “আরেহ, আমাকে ছাড় তো”।
তিনি বললেন- “না, আগে আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণের নিশ্চয়তা দিন, তারপর ছাড়ব। বিশ্বাস করুন, চারশ নাঙ্গামাথা যোদ্ধা এবং তিনশ বর্মধারী যোদ্ধা আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ থেকে নিরাপদ করে দিয়েছে। আর আপনি কিনা একদিনেই তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছেন! আমি তাদেরকে ছাড়া এক মুহূর্তও নিরাপদ নই”। তখন রাসূল (সা) বললেন- “আচ্ছা, বেশ। ওদেরকে তোমার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলাম” (ইবনে হিসাম, 517-518 পৃষ্ঠা, বঙ্গানুবাদ মিনা বুক হাউস, বাংলাদেশ)
এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সহমতে তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। তবে, নাবী (সা) তাদের প্রতি উদারতা দেখান। তাদেরকে তাদের ধনসম্পদ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। অথচ তারা সামগ্রিক ভাবে, হত্যা ও দেশদ্রোহের অপরাধী। সে অনুযায়ি, তাদেরকে খুবই সামান্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সংবিধান অস্বীকারের শাস্তি আরও কঠিন হওয়া উচিৎ ছিল।
আল্লাহ মুনাফিকদের সঙ্গে শাইত্বানের তুলনা করলেন।
59:16 নং আয়াহ : তাদের (মুনাফিকদের) উদাহরণ হল- শাইত্বানের মতো। যেমন সে (শাইত্বান) মানুষকে বলে- “তুমি সত্য অস্বীকার কর”। অতঃপর যখন সে (মানুষ) সত্য অস্বীকার করে, তখন সে (শাইত্বান) বলে- “আমি তোমার থেকে দায়মুক্ত [50:27, 14:22], আমি ভয় করি মহাবিশ্ব সমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে”।
মুনাফিক ও শাইত্বানের পরিণতি জাহান্নাম।
59:17 নং আয়াহ : অতঃপর দুজনের পরিণতি এটাই যে, দুজনে আগুনে জ্বলবে [4:145]। দুজনে তাতে অনন্তকাল থাকবে। আর ওটাই সীমালঙ্ঘনকারীদের প্রতিদান।
অপকর্ম থেকে দূরত্ব অবলম্বনের গুরুত্ব।
59:18 নং আয়াহ : হে সত্য স্বীকার করা সম্মানিত মানুষজন, তোমরা আল্লাহর জন্য তাকওয়া (অপকর্ম থেকে দূরত্ব) অবলম্বন কর। যেন প্রত্যেক সত্ত্বা/ ব্যক্তি আগামীর জন্য আগে যা পাঠিয়েছে, তার প্রতি লক্ষ্য রাখে [36:12, 82:5]। আর তোমরা আল্লাহর জন্য তাকওয়া (অপকর্ম থেকে দূরত্ব) অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, যে সমস্ত কর্ম তোমরা করছো।
ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা আল্লাহর কিতাব ভুলে গিয়েছিল।
59:19 নং আয়াহ : আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে (আল্লাহর বিধান) ভুলে গেছে [32:14, 5:13]। ফলে আল্লাহ তাদের এমন অবস্থা করলেন যে, তারা নিজেদেরকে ভুলে গেছে [4:115]। তারাই তো ফাসিক।
জান্নাতীরাই বিজেতা।
59:20 নং আয়াহ : আর সমান নয় আগুনের বাসিন্দা ও জান্নাতের বাসিন্দা [41:34, 5:100]। জান্নাতের বাসিন্দারাই বিজেতা [44:56-57]।
কুরআন কতটা ভর/ তথ্য সম্পন্ন??
59:21 নং আয়াহ : আর যদি আমরা এই কুরআনকে কোনও একটি পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম, তাহলে আপনি দেখতে পেতেন- “আল্লাহর (কথার) ভরে তা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে/ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে”। আমরা এটা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলাম। যেন মানব জাতি তাদের কাছে পেশকৃত (উদাহরণটি) নিয়ে চিন্তা ভাবনা/ গবেষণা করে।
প্রশ্ন হবে- “পাহাড়ে কুরআন নাযিল হলে, আল্লাহর কথার ভরে তা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যেত/ ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। এতে চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করার কি আছে”?? আছে, আছে, আছে। দাঁড়ান, একটু বুঝিয়ে বলি। আসলে সৃষ্টিতে *মহাবিশ্ব/ মহাবিশ্ব সমূহে) এমন কিছু নেই, যা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন নি। হয়ত সরাসরি বলেছেন, নয়ত তা সংখ্যা তত্ত্বের মাধ্যমে বলেছেন। যেমন- ‛ইউটিউব’ (Youtube) শব্দটি পবিত্র কুরআনে রয়েছে 9:106 এ। শব্দটি এই সূরাহর 2005 নং শব্দ। অবাক করা ব্যাপার হল- ইউটিউব 2005 খিঃ চালু হয়।
যেমন- সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে 500 সেকেণ্ড। মানে, 500÷60= 8.33 সেকেণ্ড। মানে, 8 মিনিট 20 সেকেণ্ড প্রায় । পবিত্র কুরআনের 75:9 এ সূর্য সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। এখন 75 কে 9 দিয়ে ভাগ করলে তা 8.33 হচ্ছে। আরও দেখুন- সূর্যের প্রধান এলিমেন্ট হল হাইড্রোজেন। যার ইংরেজি সংকেত H, আরবিতে ‛হা’। পবিত্র কুরআনের 91 নং সূরাহর নাম শামস (সূর্য)। এই সূরাহর বৈশিষ্ট্য হল- প্রত্যেকটা আয়াতের শেষ আরবি ‛হা’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যা ইঙ্গিত করছে যে সূর্যের প্রধান এলিমেন্ট হল- হাইড্রোজেন।
এখানেই শেষ নয়। এই সূরাহ পবিত্র কুরআনের 91 নং সূরাহ। অবাক করা ব্যাপার হল- সূর্যে হাইড্রোজেন এলিমেন্ট কনটেন্ট হল 91 শতাংশ। আমি যদি এভাবেই লিখতে থাকি, লেখা শেষ হওয়ার আগেই কিয়ামত হয়ে যাবে। শুধু আমি নয়, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ ও জিন যদি একত্রিত হয়ে লিখতে থাকে, তবুও লেখা শেষ হওয়ার আগে কিয়ামত হয়ে যাবে। এজন্য দেখুন 17:88 ও 31:27 আয়াত।
এখন প্রশ্ন হবে- “পাহাড় দুভাগে বিভক্ত/ ভেঙে চুরমার হবে কিভাবে”?? আসলে তথ্য = ভর। ব্যাখ্যার জন্য উদাহরণ দিই। আমরা জানি- একটি লবণের কনা থেকে যত তথ্য পাওয়া যেতে পারে, সেগুলো পূর্ণ ভাবে ধারণ করার জন্য 100 টি মানব মস্তিষ্ক প্রয়োজন। আর যদি লবণ দানা থেকে সমস্ত প্রাপ্ত তথ্য একত্রিত করা সম্ভব হয়, তাহলে দেখা যাবে- লবণের সমস্ত তথ্য = লবণের ভর। ঠিক বলছি??
তারমানে, সমগ্র সৃষ্টি জগতের ভর = পবিত্র কুরআন। মানে, পবিত্র কুরআনের সমস্ত তথ্য গুলো সৃষ্টি জগতের ভরের সমান। একারণে “পাহাড়ে কুরআন নাযিল হলে, আল্লাহর কথার ভরে তা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যেত/ ভেঙে চুরমার হয়ে যেত”। পবিত্র কুরআনের ভর পাহাড় সহ্য করবে কিভাবে!
প্রশ্ন হবে- “তাহলে নাবী (সা) কিভাবে সহ্য করলেন”?? তারও অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। হাদীশ- “কোনো কোনও সময় ওহী ঘণ্টাধ্বনির মতো শব্দ আমার কাছে আসে। আর এটিই আমার ওপর সবচেয়ে কষ্টদায়ক ওহী”(বুখারী, হাদীশ 2)। আয়িশাহ (রা) বলেন- “আমি তীব্র শীতের সময় ওহী নাযিলরত অবস্থায় তাকে (মুহাম্মাদ) দেখেছি যে, ওহী শেষ হলেই তার কপাল থেকে ঘাম ঝর ঝর করে পড়তে থাকত” (বুখারী, হাদীশ 2)।
আল্লাহ ছাড়া কোনও ঈশ্বর/ উপাস্য নেই।
59:22 নং আয়াহ : তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনও ঈশ্বর/ উপাস্য নেই [21:22, 23:91]। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্য সম্পর্কে জানেন। তিনি মহা দয়ালু ও মহা করুণাময়।
আল্লাহর কিছু নাম/ বৈশিষ্ট্য।
59:23 নং আয়াহ : তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনও ঈশ্বর/ উপাস্য নেই। তিনি মালিক, অতীব পবিত্র, শান্তিদাতা/ নিরাপত্তাদাতা, বিশ্বাসযোগ্য, রক্ষাকারী, মহা শক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য, সুপ্রিম/ সর্বোচ্চ। আল্লাহ পবিত্র তা হতে, যাকে তারা (তার সঙ্গে) শরিক করে।
আল্লাহই বিবর্তনকারী, এভাবেই সৃষ্টি জগৎ/ জীব আকৃতি পেয়েছে।
59:24 নং আয়াহ : তিনি, আল্লাহই হলেন সৃষ্টি কর্তা, বিবর্তন কারী [87:2] ও আকৃতি দাতা [24:35]। তার রয়েছে উত্তম নাম সমূহ [7:180, 17:110]। যা কিছু আছে মহাবিশ্বে ও পৃথিবীতে, সমস্ত কিছু তারই পবিত্রতা বর্ণনা করে [59:1, 17:44]। তিনি মহা শক্তিশালী ও মহা বিজ্ঞানী।