৪৮ নং সূরাহ | সূরাহ ফাতহা/ ফাতাহ | Surah no 48 | Surah Fatha/ Fatah |

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। 

অর্থ- আল্লাহর নাম নিয়ে পড়া শুরু করছি, যিনি সীমাহীন দয়ালু এবং সীমাহীন করুণাময়।

নাযিল : মাদীনাহ, আয়াত : 29 টি।

হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল ইসলামের বিজয়ের দরজা।

48:1 নং আয়াহ : নিশ্চয়ই আমরা আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি [110:1, 48:27]।

# এই আয়াহ বা সূরাহ নাযিলের পেক্ষাপট রয়েছে। এখন হাদীশ- “আনাস ইবনু মালিক (রা) তাদের বলেছেন যে, হুদাইবিয়াহ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় যখন এ আয়াত নাযিল হল- “নিশ্চয় আমরা আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি, যেন আল্লাহ … । তখন মুসলিম‌ পক্ষ তাদের সব দুঃখ-বেদনা ও ক্ষোভে পূর্ণ ছিল। আর হুদাইবিয়াতেই (কুরবানীর) পশুগুলো কুরবানী করা হয়েছিল। তখন রসূল সা) বললেন : “আমার প্রতি এমন আয়াত নাযিল হয়েছে, যা সমগ্র দুনিয়া থেকে আমার কাছে অধিক প্রিয়” (মুসলিম, হাদীশ 1786/1)।

   আসলে নাবী (সা) স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি সাহাবা (রা) দের সঙ্গে উমরাহ করতে যাচ্ছেন। সেই মতো তিনি সাহাবা (রা) দের সঙ্গে নিয়ে উমরাহর জন্য বেরিয়ে পড়লেন। হুদাইবিয়াহ নামক স্থানে মাক্কাহর কুরাইশ অমুসলিম‌দের পক্ষ থেকে বাধা পান। তারা মুসলিম পক্ষকে উমরাহ করতে দিলেন না। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হল। অবশেষে মুসলিম ও অমুসলিম পক্ষ সন্ধি করতে রাজি হলেন। যা হুদাইবিয়াহর সন্ধি নামে পরিচিত। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে সন্ধির শর্তগুলো মুসলিম পক্ষের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। শুধু বিরুদ্ধে নয়, বরং শর্তগুলো ছিল মুসলিম পক্ষের জন্য অপমানজনক। কিন্তু তা সত্ত্বেও নাবী (সা) সমস্ত শর্ত গুলো মেনে নিলেন। এজন্য সাহাবা (রা) গণ নাবী (সা) এর উপরেই রেগে গিয়েছিলেন।

   এখন শুধু একটি হাদীস দেখুন- “নাবী (সা) বাইতুল্লাহর নিকট বাধাগ্রস্ত হলেন। তখন মাক্কাহবাসীরা এ মর্মে তার সঙ্গে সন্ধি করল : “(পরবর্তী বছর) তিনি মাক্কাহয় প্রবেশ করবেন, সেখানে তিনদিন অবস্থান করবেন, কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া আর অন্য কোনও অস্ত্র নিয়ে সেখানে প্রবেশ করবেন না। আর কোন‌ও মাক্কাহবাসী কাউকে নিয়ে মাক্কাহ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন না। পক্ষান্তরে তার/ নাবীর সাহাবা (রা) দের কেউ যদি সেখানে থেকে যেতে চায়, তবে তাকে বারণ করবেন না”।

   তখন তিনি (নাবী) আলী (রা) কে বললেন যে, আমাদের মধ্যকার শর্তগুলো এভাবে লিখে নাও : “বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রাহীম ….. এ হচ্ছে সেই সন্ধি, যা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ চূড়ান্ত করেছেন”। তখন মুশরিকরা তাকে বলল : “আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূলই জানতাম, তবে আপনার অনুসরণই করতাম। বরং লিখুন : মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ” (আব্দুল্লাহ‌র পুত্র মুহাম্মাদ)‌।

   তখন তিনি আলী (রা) কে তা মুছে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। আলী (রা) বললেন : “আল্লাহর কসম, আমি তা মুছতে পারব না”। তখন রাসূল (সা) বললেন : “তাহলে আমাকেই স্থানটি দেখিয়ে দাও”। তিনি সে স্থান দেখিয়ে দিলেন এবং তিনি (নাবী) তা (স্বহস্তে) মুছে ফেললেন এবং লিখালেন- মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ।

   তারপর (পরের বছর তিনি সাহাবাদের নিয়ে এলেন এবং) সেখানে তিনি তিনদিন অবস্থান করলেন। যখন তৃতীয়দিন সমাগত হল, তখন তারা আলী (রা) কে বললেন : “এটা হচ্ছে তোমার সাথি/ নাবীর শর্তের স্থিরীকৃত শেষ দিবস। তাকে বেরিয়ে যেতে বলে দাও”। তখন তিনি তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করলেন। তিনি বললেন : “হ্যাঁ”। পরে তিনি বেরিয়ে গেলেন”(মুসলিম, হাদীশ, 1783/3)।

   একটা প্রশ্ন হবে- “মাক্কাহর অমুসলিম‌রা এত সহজে নাবী (সা) এর সঙ্গে চুক্তিতে রাজি হলেন কিভাবে”?? উত্তর‌টা রয়েছে 48:24 এ। আসলে মাক্কাহর 80 জন নাবী (সা) এবং সাহাবা (রা) দের উপর আক্রমণ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। নবী (সা) তাদেরকে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দেন। ফলত তারাও খানিকটা নমনীয়তা দেখিয়ে চুক্তি করতে রাজি হয়ে যান। এছাড়াও মাক্কাহর বহু অমুসলিম নেতৃত্ব নাবী (সা) এর পক্ষে বলেন- “সে (নাবী) তো যুদ্ধ করতে আসে নি, উমরাহ করতে চাইছে, তাকে বাধা দেওয়া ঠিক হবে না” (বুখারী, হাদীশ 2732)।

নাবী (সা) এর আগের ও পরের ভুলত্রুটি ক্ষমা করা হয়েছে।

48:2 নং আয়াহ : যেন আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করেন। যে সমস্ত ভুল ত্রুটি (এই সূরাহর) পূর্বে‌ হয়েছে এবং যে সমস্ত (ভুল ত্রুটি) হবে পরে [47:19]। আর যেন তিনি আপনার প্রতি তার নিয়ামত/ অনুগ্রহ সম্পূর্ণ [5:3] করেন। আর যেন আপনাকে পরিচালনা করেন চূড়ান্ত সফলতার পথে [36:4, 43:43, 22:67]।

# নাবী (সা) কি পাপী ছিলেন?? না, তবে সাধারণ মানবীয় ভুলত্রুটি তার হোত। তবে তিনি সচেতন থাকতেন, এজন্য তার ভুল ত্রুটির পরিমাণ মানব ইতিহাসে যে কোনও মানুষের তুলনায় সবচেয়ে কম। তাই তিনি মহা মানব। তিনি নিজেই বলেছেন- “প্রতিটা আদম সন্তান‌ই ভুল করে, কিন্তু তাদের মধ্যে উত্তম সে, যে ভুল সংশোধন করে নেয়” (তিরমিযী, হাদীশ 2499)।

আল্লাহ নাবী (সা) কে প্রবলভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন।

48:3 নং আয়াহ :  আর যেন আল্লাহ আপনাকে প্রবলভাবে সাহায্য করেন [110:2-3]।

হুদাইবিয়ার সন্ধি দ্বারা মূমীন‌দের প্রশান্ত/ সন্তুষ্ট হ‌ওয়ার ভবিষ্যৎ।

48:4 নং আয়াহ : তিনিই (আল্লাহ), যিনি সুকূন/ প্রশান্তি নাযিল করবেন [48:18] মূমীন/ সত্য স্বীকারকারীদের মস্তিষ্ক সমূহে। যেন তিনি তাদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আত্মবিশ্বাস যুক্ত করে আরও শক্তিশালী করেন। মহাবিশ্বের সৈন্য/ বাহিনী সমূহ (ফেরেস্তারা) আল্লাহর‌ই অধীন [48:7]। আল্লাহ জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী।

# আপাত দৃষ্টিতে এই সন্ধি মুসলিম পক্ষের জন্য অপমান জনক ছিল। কিন্তু এই সন্ধি মুসলিম‌দের জন্য, ইসলামের বিজয়ের জন্য সুফল বয়ে এনেছিল। কেননা, মাক্কাহ‌বাসী মাদীনাহতে আসতে না পারলেও, মাদীনাহর মুসলিম‌রা মাক্কাহ‌তে যেতে পারত। ফলতঃ মাক্কাহবাসীর কাছে খুব‌ই সহজে ইসলাম পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছিল‌। এর মাধ্যমে গোপন গোপনে মাক্কাহ‌বাসী ইসলামের শিক্ষা‌র সঙ্গে পরিচয় লাভ করে এবং ইসলাম গ্ৰহণ করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল। এর মানে, এই সন্ধিই ইসলামের বিজয় এনেছিল। তাই আল্লাহ বলেছেন- “নিশ্চয়ই আমরা আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি” (48:1)।

মূমীন নরনারী‌দের ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ।

48:5 নং আয়াহ : যেন তিনি সত্য স্বীকারকারী পুরুষ ও সত্য স্বীকারকারী নারীদের প্রবেশ করান জান্নাতে, যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ভাবে প্রবাহিত হবে নদনদী। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আর যেন তিনি তাদের ভুল ত্রুটি/ পাপ সমূহ‌কে ধ্বংস করে দেন [39:53, 25:70]। ওটাই হল আল্লাহর কাছে মহা সাফল্য [9:72]।

আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখার পরিণতি।

48:6 নং আয়াহ : আর আল্লাহ শাস্তি দেবেন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীদের‌কে [4:145], মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদের‌কে [4:48, 4:116]। আর যারা আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ/ ভ্রান্ত ধারণা করে, তাদের জন্য আসবে চক্রাকারে অকল‍্যাণ। আল্লাহ ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাদের প্রতি লানত/ ঘৃণা। তাদের প্রস্তুত করছেন জাহান্নাম। এবং তা খুবই নিকৃষ্ট গন্তব্য [98:6]।

ফেরেস্তা‌রা আল্লাহর অধীনে/ নিয়ন্ত্রণে।

48:7 নং আয়াহ : মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর সৈন্য/ বাহিনী সমূহ (ফেরেস্তা‌রা) আল্লাহর অধীন [48:4]। তিনি শক্তিশালী ও বিজ্ঞানী।

নাবী (সা) এর বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য।

48:8 নং আয়াহ : নিশ্চয়ই আমরা আপনাকে প্রেরণ করেছি (সত‍্যের প্রতি) সাক্ষ্য‌দাতা, সুসংবাদ‌দাতা ও সতর্ককারী [21:107] হিসাবে।

সাহাবা (রা) দের ও মূমীনদের কিছু দায়িত্ব।

48:9 নং আয়াহ : যেন তোমরা স্বীকার কর আল্লাহকে ও তার রাসূল‌কে। আর যেন তাকে সাহায্য কর [47:7, 22:40], তাকে সম্মান কর [49:2] এবং আল্লাহর পবিত্র‌তা বর্ণনা কর [57:1] সকাল ও সন্ধ্যায় [11:114, 33:41-42]।

নাবী (সা) হাতে বাইয়াত ও তার গুরুত্ব।

48:10 নং আয়াহ : নিশ্চয়ই যারা আপনার কাছে বাইয়াত/ অনুগত‍্যের শপথ করে, মূলত তারা বাইয়াত/ অনুগত‍্যের শপথ করে আল্লাহর কাছে [4:80, 4:150]। আল্লাহর হাত তাদের হাত গুলোর উপর। মূলত যে শপথ ভঙ্গ করে, সে নিজের ক্ষতির জন্য‌ই করে [5:1,;17:34]। আর যে সেই বিষয়ে আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করে, শীঘ্রই তাকে দেবেন বিরাট প্রতিদান [18:30]।

# এই আয়াহ দেখিয়ে অনেক সূফী/ পীরপন্থীরা বলে থাকেন- “আসলে আল্লাহ ও রাসূল (সা) এর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, উভয়ে এক‌ই”। যেমন দাবি করেন খৃষ্টান‌রা। এর সমর্থনে আনেন 4:80 ও 4:150 আয়াত। এখানে উদেশ্য গত ভাবে আল্লাহ ও রাসূল (সা) এর মধ্যে পার্থক্য না থাকার কথা বলা হচ্ছে। যেমন, যিশু/ ঈশা (আ) বলেছেন- “আমি ও পিতা/ ঈশ্বর, আমরা এক”(Jhon, 10:30)। তিনি আরও বলেছেন- “যে আমাকে দেখছে, সে পিতা/ ঈশ্বর‌কে দেখছে”(Jhon, 14:9)।

   উত্তর কি হবে?? উত্তর খুব সহজ। যদি আল্লাহ ও রাসূল (সা) এক হয়ে থাকেন, তাহলে আল্লাহ যা জানবেন, রাসূল (সা) তা-ই জানবেন। তাই না?? যিশু/ ঈশা (আ) ও ঈশ্বর এক হয়ে থাকেন, তাহলে ঈশ্বর যা জানবেন, তিনিও তা-ই জানবেন। তাই না?? কিন্তু যিশু/ ঈশা (আ) কিয়ামতের সময় সম্পর্কে বলেছেন- “সেই দিন বা সময় সম্পর্কে কেউ জানেন না। না আকাশের ফেরেস্তা‌রা, না পুত্র। জানেন শুধু পিতা/ ঈশ্বর” (Matthew, 24:36 ও Mark, 13:32)।

   কুরআনে‌ও একই ধরণের কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন 4:113 তে- “আপনাকে (নাবীকে) তা জানান হয়েছে, যা আপনি (নাবী) জানতেন না”। তারমানে, নাবী (সা) অনেক কিছু জানতেন না, যা আল্লাহ জানতেন। তারমানে, আল্লাহ ও রাসূল (সা) উভয়ে এক নন। এছাড়াও কিয়ামতের সময় সম্পর্কে রাসূল বলেছেন- “এর সঠিক সময়ে‌র জ্ঞান আল্লাহর কাছে”(33:63)। তারমানে, রাসূল (সা) এবং আল্লাহ উভয়ে এক নন।

তৎকালীন আরবের মুনাফিক ও তাদের বক্তব্য।

48:11 নং আয়াহ : পিছনে থেকে যাওয়া (যারা হুদাইবিয়া তে ছিল না) আরববাসীরা শীঘ্রই আপনাকে বলবে- “আমাদের‌কে ব‍্যস্ত রেখেছিল আমাদের ধনসম্পদ ও আমাদের পরিবার পরিজন, সুতরাং (রাগ করবেন না, বরং) আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন”। তারা তাদের জ্বিহা দিয়ে এমন কথা বলে, যা তাদের মস্তিষ্কে নেই। বলুন- “যদি আল্লাহ তোমাদের ক্ষতি করার ইরাদা করেন বা কল‍্যাণ করার ইরাদা করেন, তবে কে তোমাদের‌কে আল্লাহর থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখে! বরং আল্লাহ সেই সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, যে সমস্ত আমল/ কর্ম তোমরা করছো [3:15, 84:15]।

মুনাফিকরা নাবী (সা) ও সাহাবা (রা) দের সম্পর্কে যা ভেবেছিল।

48:12 নং আয়াহ : বরং তোমরা (মুনাফিক‌রা) ভেবেছিলে যে, রাসূল ও মূমীনরা কখনও তাদের পরিবার পরিজনদের কাছে ফিরে আসতে পারবেন না এবং তোমাদের ঐ ধারণা তোমাদের মস্তিষ্ক সমূহের জন্য সুখকর ছিল। কিন্তু তোমাদের ধারণা ছিল ভুল। আর (জেনে রেখ), তোমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সম্প্রদায়”।

জাহান্নামে ‛সৌর ঝড়ের মতো’ ঝড় উঠবে।

48:13 নং আয়াহ : আর যে স্বীকার করে না আল্লাহ ও তার রাসূলকে, তবে নিশ্চয়ই আমরা সত্য অস্বীকার‌কারীদের জন্য প্রস্তুত করছি ঝড় সৃষ্টি‌কারী আগুন [77:32-33।

# জাহান্নামের সঙ্গে সূর্যের এত মিল কেন?? উত্তর‌টা খুব সহজ- আমাদের এই মহাবিশ্ব‌ই একদিন জাহান্নামে পরিণত হবে। কিভাবে?? চলে যান 69:16-17 ও 84:1-5 এ। ওখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

ক্ষমা ও শাস্তি প্রদান আল্লাহর অধীন।

48:14 নং আয়াহ : আর মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর। তিনি যাকে চান, ক্ষমা করেন। যাকে চান, শাস্তি দেন [3:129, 5:40]। কেননা, তিনি হলেন ক্ষমাশীল ও করুণাময়।

মুনাফিক‌দের সম্পর্কে নাবী (সা) কে বিশেষ নির্দেশ।

48:15 নং আয়াহ : শীঘ্রই যখন তোমরা (খাইবার অভিযান থেকে প্রাপ্ত) গনিমতের দিকে যাবে, তখন পিছনে থেকে যাওয়া মানুষ গুলো [48:11] বলবে- “আমাদের‌কে তা গ্ৰহণ করার জন্য যেতে দাও, আমরা তোমাদের অনুসরণ করব”। তারা আল্লাহর কালাম/ বাণী পরিবর্তন করতে চায়। বলুন- “তোমরা কখনও আমাদের অনুসরণ করবে, তোমাদের সম্পর্কে আল্লাহ আগেই আমাদেরকে এই এই বলে দিয়েছেন”। তখন তারা অবশ্যই বলবে- “তোমরা তো আমাদের‌কে হিংসা করছ”। আসলে তারা অতি সামান্য‌ই বোঝে!

# ঠিক একারণেই যারা হুদাইবিয়াতে ছিলেন না, খাইবার অভিযান থেকে প্রাপ্ত গনিমত তাদেরকে দেওয়া‌ও হয় নি।

রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ বাণী।

48:16 নং আয়াহ : পিছনে থেকে যাওয়া আরববাসীদের বলুন- “শীঘ্রই তোমাদের‌কে ডাকা হবে প্রবল শক্তিশালী এক জাতির বিরুদ্ধে (রোমানদের বিরুদ্ধে, মূতাহ’র যুদ্ধে)। হয়ত তাদের সঙ্গে তোমাদের‌কে যুদ্ধ করতে হবে অথবা নয়ত তারা আত্মসমর্পণ করবে। অতঃপর যদি তোমরা অনুসরণ কর (আল্লাহ ও তার রাসূলের), তাহলে আল্লাহ তোমাদের‌কে উত্তম প্রতিদান দেবেন। আর যদি পিছনে ফিরে যাও, যেমন ইতিপূর্বে পিছনে ফিরে গিয়েছিলে [48:11], তাহলে তিনি তোমাদের‌কে কষ্টদায়ক শাস্তি প্রদান করবেন।

নাবী (সা) এর সঙ্গে যুদ্ধে ‛না যাওয়া’ যাদের জন্য অপরাধ ছিল না।

48:17 নং আয়াহ : তবে (যুদ্ধে না যাওয়া) অপরাধ নয় অন্ধের জন্য, আর না অপরাধ খোঁড়ার জন্য, আর না অপরাধ রোগীর জন্য। তবে যে অনুগত‍্য করে আল্লাহর ও তার রাসূলের, তাকে তিনি প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যেখানে নিয়ন্ত্রণাধীন ভাবে প্রবাহিত হবে নদনদী। আর যে পিঠ ফেরাবে, তাকে তিনি কষ্টদায়ক শাস্তি দেবেন।

হুদাইবিয়া‌তে থাকা সাহাবা (রা) গণ জান্নাতী।

48:18 নং আয়াহ : অবশ্যই আল্লাহ মূমীনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা আপনার কাছে বাইয়াত/ অনুগত‍্যের শপথ করছিল গাছটির নিচে [98:8]। আর তিনি (আল্লাহ) জানতেন, যা তাদের (সাহাবাদের) মস্তিষ্কে চলছিল। ফলে তাদের উপর সুকূন/ প্রশান্তি নাযিল [48:4] করলেন। এবং তাদেরকে সাওয়াব/ প্রতিদান হিসাবে দিলেন নিকটবর্তী (খাইবার) বিজয়।

# এই বাইয়াত‌কে “বাইয়াতে রিদ্ব‌ওয়ান” বলা হয়। নাবী (সা) বলেছেন- “আল্লাহ চান তো বৃক্ষের নীচে বসে বাইয়াতে রিদ্বওয়ানে অংশগ্রহণকারীদের কেউই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না” (মুসলিম, হাদীশ 2496)।

মূতাহ’র যুদ্ধ হতে বিপুল গনিমত লাভের ভবিষ্যৎ বাণী।

48:19 নং আয়াহ : এবং বিপুল পরিমাণে গনিমত/ যুদ্ধ‌লব্ধ সম্মদ তারা হাতে পাবে। আল্লাহ শক্তিশালী ও বিজ্ঞানী।

48:20 নং আয়াহ : আল্লাহ তোমাদের‌কে ওয়াদা করেছেন বিপুল পরিমাণ গনিমত/ যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পদ লাভের, তা তোমরা হাতে পাবে। এর জন্য ব‍্যবস্থা তিনি করবেন। আর তিনি তোমাদের উপর থেকে মানুষদের (কুরাইশ‌দের) হাত গুলোকে বিরত রাখলেন [48:24]। যেন মূমীনদের জন্য তা হয় একটি নিদর্শন। আর তিনি তোমাদের‌কে চালনা করবেন চূড়ান্ত সফলতার পথে।

মাক্কাহ বিজয়ের ভবিষ্যৎ বাণী।

48:21 নং আয়াহ : আরও একটি বিজয় পাবে, যা তোমরা এখনও পাও নি। অবশ্যই আল্লাহ তা (বিজয়) কে ঘিরে রেখেছেন [110:1-2]। আর আল্লাহ সমস্ত কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

কুরাইশ‌রা হুদাইবিয়া‌তে যুদ্ধ করলে, বিশ্রী ভাবে হেরে যেত।

48:22 নং আয়াহ : আর যদি তারা (মাক্কাহর কুরাইশ‌রা) তোমাদের সঙ্গে (হুদাইবিয়াতে) যুদ্ধ করত, তাহলে অবশ্যই তারা পিঠ দেখাত (পালিয়ে যেত)। তারপর তারা না পেত কোনও ওলী/ অভিভাবক [41:31], আর না পেত কোনও নাস্বীর/ সাহায্য‌কারী [3:173]।

আল্লাহর সুন্নাত/ রীতিতে বদল নেই।

48:23 নং আয়াহ : আল্লাহর সুন্নাত/ রীতি, যা পূর্ব হতেই চলে আসছে। আর আল্লাহর সুন্নাত/ রীতিতে আপনি কোনও বদল পাবেন না [35:43, 50:29]।

নাবী (সা) ও সাহাবা (রা) দের উপর হামলার চক্রান্ত ব‍্যর্থ হয়।

48:24 নং আয়াহ : আর তিনি (আল্লাহ), যিনি মাক্কাহর কাছাকাছি (হুদাইবিয়াতে) তোমাদের উপর থেকে তাদের হাত গুলোকে, তাদের উপর থেকে তোমাদের হাত গুলোকে বিরত রাখলেন। কিন্তু তাও (যুদ্ধ ছাড়াই) তোমাদের‌কে তাদের উপর বিজয় দিলেন [48:20]। আর আল্লাহ সেই সমস্ত বিষয় দেখছেন, যে সমস্ত আমল/ কর্ম তোমরা করছ।

# নাবী (সা) হুদাইবিয়া‌তে ছিলেন। এই সময় মাক্কাহর 80 জন অস্ত্র সহ নাবী (সা) এবং সাহাবা (রা) দের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তারা তান‌ঈম পাহাড়ে লুকিয়ে ছিল। নাবী (সা) তাদেরকে গ্ৰেফতার করেন। যদিও শাস্তি না দিয়েই তাদেরকে মুক্তি দেন। সেই পেক্ষিতেই এই আয়াহ নাযিল হয়”(মুসলিম, হাদীশ, 1808)।

কেন হুদাইবিয়া‌তে নাবী (সা) যুদ্ধ করেন নি??

48:25 নং আয়াহ : তারাই কাফির/ অধিকার হননকারী, যারা মাসজিদুল হারামে যেতে তোমাদের‌কে এবং কুরবানীর পশুগুলো‌কে যথা স্থানে [22:33] পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে। আর যদি (মাক্কাহ‌তে কাফিরদের মাঝে) মূমীন পুরুষ ও মূমীন নারী না থাকত, যাদের সম্পর্কে তোমরা না জানার কারণে তাদেরকে পদদলিত করতে। ফলে তাদের কারণে তোমরা (নিজেদের‌কে) দোষী ভাবতে (ফলত আল্লাহ তার রাসূল‌কে চুক্তি/ সন্ধির নির্দেশ দিয়েছেন)। (এজন্য‌ও) যেন আল্লাহ তার রহমতের মধ্যে যাকে চান, তাকে প্রবেশ করিয়ে নেন (১)। তবে যদি তারা (মাক্কাহর কাফির ও মূমীনরা) পৃথক থাকত, তাহলে তাদের মধ্যে যারা সত‍্যের বিরোধিতা করছে, তাদেরকে আমরা কষ্টদায়ক শাস্তি দিতাম।

১ কে নাবী (সা) এর সিদ্ধান্তের পক্ষে আছেন, আর কে তার বিপক্ষে আছেন, তা সুস্পষ্ট হয়ে গেল। এটা ইমানের পরীক্ষা‌ও ছিল বটে। যে পক্ষে থাকবেন, তাকে আল্লাহ তার রহমতের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নেবেন।

# সাহাবা (রা) রা ভাবছিলেন- “কেন এই অপমান জনক চুক্তি/ সন্ধিতে নাবী (সা) রাজি হলেন”! এখানে তার 3 টি অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।

মাক্কাহ‌তে মুসলিম‌দের প্রবেশে কেন বাধা দিচ্ছিল কুরাইশ‌রা??

48:26 নং আয়াহ : যখন কাফির/ অধিকার হনন‌কারী‌রা মূর্খ‌তার জন্য মস্তিষ্কে জিদ সহ একগুঁয়েমি পোষণ করল, তখন আল্লাহ তার রাসূলের ও মূমীনদের উপর সুকূন/ প্রশান্তি নাযিল করলেন। আর তাদেরকে তাক‌ওয়া (অপকর্ম থেকে দূরত্ব অবলম্বনের) কালিমা/ বাক্যে সংহতি গড়ে দিলেন এবং তারা ছিল এর অধিক যোগ্য ও উপযুক্ত। আর আল্লাহ প্রত‍্যেকটা বিষয়ে জ্ঞান রাখেন।

# এই সম্পর্কে বুখারীর 2732 এ একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীশ রয়েছে। গিয়ে একবার দেখে আসতে পারেন, আয়াহটাকে বুঝতে সুবিধা হবে এবং জ্ঞান বৃদ্ধি‌ও হবে। আমি হাদীশ‌টা এখানে আনতে পারতাম, কিন্তু হাদীশ‌টা অনেক আকারে অনেক বড়, তাই আনলাম না‌।

স্বপ্ন দ্বারা‌ও ওহী করা হোত, নাবীদের স্বপ্ন মিথ্যা হয় না।

48:27 নং আয়াহ : অবশ্যই আল্লাহ তার রাসূলের স্বপ্ন‌কে যথাযথ ভাবে সত্যে পরিণত করেছেন। ইন শায়া আল্লাহ, অবশ্যই তোমরা মাসজিদুল হারামে নিরাপদে প্রবেশ করবে। কেউ মুণ্ডন‌কারী হয়ে, কেউ মাথার চুল ছোট করে এবং কোনও ধরণের ভয় ছাড়াই [2:196]। তবে আল্লাহ তা জানেন, যা তোমরা জান না। অতঃপর তার মাধ্যমে তোমাদের‌কে দিলেন একটি আসন্ন (মাক্কাহ) বিজয় [48:4]।

ইসলামের বিজয় নিশ্চিত, সামনে কোনও ধর্ম টিককে না।

48:28 নং আয়াহ : তিনি (আল্লাহ), যিনি তার রাসূল‌কে পথনির্দেশনা ও সত্য দীন সহ প্রেরণ করেছেন [61:9, 9:33]। যাতে (ইসলামকে) সমস্ত বিকৃত ধর্ম গুলোর উপর বিজয়ী করেন [3:19, 42:13]। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ যথেষ্ট।

সাহাবা (রা) গণ এবং মুসলিম‌দের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য।

48:29 নং আয়াহ : মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। যারা তার সঙ্গে (সাহাবাগণ) আছে, তারা কাফির/ মাদীনাহ সনদ অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর (১)। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে/ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আপনি দেখবেন যে, তারা (সাহাবাগণ) রুককারী এবং সিজদা‌কারী [9:112]। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ এবং সন্তুষ্টি সন্ধান করে। তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন রয়েছে। তাদের এই গুণ ও পরিচয় বর্ণিত ছিল তাওরাত ও ইঞ্জিলে (২)। তারা একটি চারাগাছের মতো, যা থেকে বের হয় কচিপাতা। তারপর তা শক্তিশালী হয়, মোটা হয়, তারপর তার কাণ্ডের উপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। যা আনন্দ দেয় চাষীদের‌কে (৩)। তিনি তাদের (সাহাবাদের) দ্বারা কাফির/ মাদীনাহ সনদ অস্বীকারকারীদের ভিতরে জ্বালার সৃষ্টি করেন। তবে আল্লাহ তাদের‌কে ওয়াদা করেছেন যে, তাদের মধ্যে যারা সত্য স্বীকার করবে ও সৎকর্ম করবে, তাদের জন্য থাকবে ক্ষমা ও মহা প্রতিদান [57:21, 3:133]।

১) আসলে নাবী (সা) বহু মুসলিম সাহাবা সহ মাদীনাহতে আসেন। এসে মাক্কাহর মুসলিম, মাদীনাহর মুসলিম ও ইহুদীদের মধ্যে একটু প্রাথমিক ও মৌলিক সংবিধান তৈরি করেন। যার নাম- মাদীনাহ সনদ। এর দ্বারাই প্রাথমিক ভাবে ‛মাদীনাহ রাষ্ট্র’ পরিচালিত হতে থাকে। মাদীনাহর ইহুদী গোত্র গুলোও সংবিধানে সাক্ষর করেন। কারণ ইহুদীদের সার্বিক নিরাপত্তার কথাও সংবিধানে ছিল। কিন্তু ইহুদী গোত্র বারবার সংবিধান অস্বীকার ও লঙ্ঘন ক‍রতে থাকে। তাই এখানে বলা হচ্ছে- “সাহাবাগণ কাফির/ মাদীনাহ সনদ অস্বীকার‌কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর”। এই সম্পর্কে 59:2 ও 59:15 তে বিস্তারিত কথা বলা হয়েছে।

২) মনে হয় এখানে Plasms এর 95:6 এর কথা বলা হচ্ছে। যেখানে বলা রয়েছে- “Oh come, let us worship and bow down; Let us kneel before the Lord our Maker”। যার অর্থ- “এস, ঈশ্বরের ইবাদত করি। রুকু ও সিজদা করি। কেননা, তিনি আমাদের প্রভু ও সৃষ্টিকর্তা”। যদিও তাওরাত ও ইঞ্জিল আগের অবস্থায় নেই, তাদের মানব হস্তক্ষেপ হয়েছে অহরহ ভাবে (4:46, 5:13)।

৩) এখানে মুসলিমদের‌কে শস্য গাছ/ ধান, গম ইত্যাদি‌র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শান্তি প্রিয় মানুষদেরকে চাষীদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন মুসলিমের আচার আচরণ ও কর্ম শান্তি প্রিয় মানুষ‌দের আনন্দ দেবে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন, আজকের মুসলিম‌দের আচার আচরণ ও কর্ম শান্তি প্রিয় মানুষ‌দের আনন্দ দেয় না।

3.7/5 - (3 votes)
শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন